বাতিল হচ্ছে ওয়াইম্যাক্স অপারেটর বাংলালায়ন ও কিউবির লাইসেন্স। গত ৫ বছরে এই দুটি অপারেটর
মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা গেছে, এই মতামতের ওপর ভিত্তি করে সরকার কতটি অপারেটরকে নতুন করে লাইসেন্স দেবে তা নির্ধারণ করবে। সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, ইতিমধ্যে রাশিয়ান কোম্পানি ওলোসহ আরও কয়েকটি কোম্পানি ওয়াইম্যাক্স লাইসেন্সের জন্য সরকারের কাছে আবেদন জানিয়েছে। মন্ত্রণালয়ের একটি সূত্র জানায় ওলো ইতিমধ্যে ২০ হাজারের বেশি গ্রাহককে ইন্টারনেট সংযোগ প্রদান করেছে। তাদের সেবার মানও বিদ্যমান অপারেটর দুটির চেয়ে অনেক ভালো। ওলো ছাড়াও আরও বেশ কয়েকটি আইএসপি অপারেটর ভালোমানের ও দ্রুতগতির ইন্টারনেট সেবা দিচ্ছে।
ডাক ও টেলিযোগাযোগ মন্ত্রণালয় তাদের ওয়েবসাইটে দেয়া বিডব্লিউএ গাইডলাইনে বলেছে, দেশী-বিদেশী অন্য অপারটরকে এই লাইসেন্স নেয়ার জন্য উৎসাহিত করা হবে। কারণ বর্তমানে দুটি অপারেটর বাংলালায়ন ও কিউবি যারা এই লাইসেন্স পেয়েছে তারা সরকারের টার্গেট বাস্তবায়নে সম্পূর্ণ ব্যর্থ হয়েছে। একই সঙ্গে সরকারের অন্যতম লক্ষ্য ডিজিটাল বাংলাদেশ বাস্তবায়নে বড় ধরনের হোঁচট খেতে হয়েছে। এই অবস্থায় বাংলাদেশ টেলিযোগাযোগ নিয়ন্ত্রণ কমিশন (বিটিআরসি) লাইসেন্সের শর্ত পূরণ ও জনসাধারণের চাহিদা পূরণে ব্যর্থ অপারেটর দুটির বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নিতে যাচ্ছে। দুটি অপারেটরের মনোপলি ব্যবসা ভাঙতে এবং স্থানীয় গ্রাহকদের স্বার্থ রক্ষায় বিটিআরসি আরও একাধিক অপারেটরকে এই লাইসেন্স দেবে।
টেলিযোগাযোগ মন্ত্রণালয়ের সচিব আবু বক্কর সিদ্দিক বলেছেন, ডিজিটাল বাংলাদেশ বাস্তবায়ন ও দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলের জনসাধারণের মাঝে ইন্টারনেট সেবা পৌঁছে দিতে তারা আরও কয়েকটি অপারেটরকে বিডব্লিউএ লাইসেন্স দেয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। এ লক্ষ্যে বিডব্লিউএ গাইডলাইনে সংশোধনী আনা হচ্ছে। আজ বিকাল পর্যন্ত এ বিষয়ে জনগণের মতামত নেয়া হচ্ছে। এরপরই সিদ্ধান্ত হবে বিদ্যমান অপারেটরদের বিরুদ্ধে কী ধরনের ব্যবস্থা নেয়া হবে এবং কতগুলো অপারেটরকে লাইসেন্স দেয়া যাবে।
বিটিআরসি চেয়ারম্যান সুনীলকান্তি বোস জানান, বিদ্যমান দুটি অপারেটর গাইডলাইনের বেশিরভাগ শর্ত পূরণে ব্যর্থ হয়েছে। তিনি বলেন, গাইডলাইন অনুযায়ী লাইসেন্স প্রাপ্তির প্রথম বছরে বাংলালায়ন ও কিউবিকে দেশের ৭টি বিভাগের প্রতিটিতে কমপক্ষে ৫টি করে বিটিএস বসানোর কথা ছিল। একই সঙ্গে ১২টি ‘এ’ ক্যাটাগরির জেলার প্রতিটিতে গড়ে কমপক্ষে ৩টি করে বিটিএস বসানোর শর্ত ছিল। পরবর্তী বছরে এটি দ্বিগুণ ও তৃতীয় বছরে সারাদেশে তাদের সংযোগ ছড়িয়ে দেয়ার কথা ছিল। কিন্তু তারা এটি বাস্তবায়নে ব্যর্থ হয়েছে। এই অবস্থায় বিটিআরসি এ ব্যবসার একক মনোপলি ভাঙা ও সরকারের ডিজিটাল বাংলাদেশ বাস্তবায়নে আরও লাইসেন্স দেয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে।
এদিকে সরেজমিন রাজধানীসহ দেশের বিভিন্ন এলাকায় ঘুরে ও খোঁজ নিয়ে দেখা গেছে, ওয়াইম্যাক্স ইন্টারনেট সেবাদানকারী প্রতিষ্ঠান বাংলালায়ন ও কিউবির গ্রাহকরা চরম ভোগান্তির শিকার হচ্ছেন। গ্রাহকদের অভিযোগ, বাংলালায়ন ও কিউবির সেবার মান বাড়েনি। বেড়েছে নানারকম সমস্যা। প্রায়ই ইন্টারনেট সেবা বন্ধ হয়ে যাচ্ছে। মাঝে মধ্যেই বাংলালায়নের নেটওয়ার্কে যুক্ত হতে সমস্যা হয়। দীর্ঘ সময় কানেকটিং দেখিয়ে ফেইল্ড দেখায়। লালমাটিয়ার বাসিন্দা এম রহমান জানান, তিনি বাংলালায়নের একটি সংযোগ ক্রয় করেও ব্যবহার করতে পারেননি। ২০ ফুট লম্বা তার ক্রয় করে মডেম ছাদে নিয়েও সংযোগ পাননি।
মাসে কমপক্ষে ৫-৭ দিন ‘সার্ভার’ নষ্ট থাকায় ৩০-৪০ ঘণ্টা ইন্টারনেট থেকে বিচ্ছিন্ন থাকতে হচ্ছে। নিয়ম অনুযায়ী এক মেগাবাইট ব্যান্ডউইথ দিয়ে সর্বাধিক ৮ জন গ্রাহককে সংযোগ দেয়ার কথা থাকলেও বাংলালায়ন ও কিউবি ৩০-৩৫ জন গ্রাহককে সংযোগ দিচ্ছে। এতে নিরবছিন্ন সংযোগ পাওয়া যাচ্ছে না। প্রতি মাসে গ্রাহকরা ইন্টারনেটের পেছনে ১ হাজার ৪৩৭ টাকা থেকে ২ হাজার টাকা বিল দিলেও ভোগান্তি লেগে থাকছে। বাংলালায়নের বিক্রেতাদের ফোন করলে তারা নিজেদের সেলসের লোক পরিচয় দিয়ে সমস্যা সমাধানে অপারগতা প্রকাশ করেন। কাস্টমার কেয়ারে ফোন দিলে ১০/১৫ মিনিট বসিয়ে রেখে লাইন কেটে দেয়। মোহাম্মদপুরের বাসিন্দা রাসেল জানান, সকালের দিকে কিছুটা স্পিড থাকে বাংলালায়নে। দুপুরের পর থেকে মধ্যরাত পর্যন্ত ৫১২ আনলিমিটেড প্যাকেজ হয়ে যায় ১২৮ কেবিপিএসের প্যাকেজ।
বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় নর্থসাউথের ছাত্র রাফিন বলেন, ভার্সিটির ক্লাসের ফাঁকে তিনি ল্যাপটপে বাংলালায়ন ব্যবহার করেন। কিন্তু মাঝে মাঝেই বাংলালায়নের টেকনিক্যাল সমস্যার কারণে অতি প্রয়োজনীয় কাজগুলোও সময়মতো করতে পারেন না।
ঢাকার বাইরের অবস্থা আরও করুণ। চট্টগ্রামের বাসিন্দা মিজান জানান, কেনার আগে কানেকশন টেস্ট করার সময় বেশ ভালো স্পিড পাওয়া যায়। কিন্তু ব্যবহারের কিছুদিন পর চেহারা পাল্টে যায়। তিনি বলেন, দিনে খুবই স্লো স্পিড। দিনে গড়ে ২-৩ ঘণ্টা কানেকশন থাকে না। বড় ফাইল ডাউনলোড করা যায় না। বাংলালায়নে একটানা ২ ঘণ্টা ডাউনলোড করলে লাইন ব্লক করে দেয়। কখনও স্পিড অর্ধেক করে দেয়।
২০০৯ থেকে বাংলালায়ন ব্যবহার করছেন অ্যাডভান্স হিয়ারিং সেন্টারের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা (সিইও) মোঃ ওমর ফারুক। তিনি বাংলালায়নের ব্যাপারে ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেন, বাংলালায়নের সার্ভিস একেবারে নিুমানের। কোম্পানিটি এখন বিতর্কিত। চরম ক্ষুব্ধ হয়ে বাংলালায়নের গ্রাহক ফয়সাল ফেসবুকে লিখেছেন, বাংলালায়ন এখন বাংলা শেয়ালে পরিণত হয়েছে।
গাইডলাইনের অধিকাংশ শর্ত পূরণ করতে পারেনি। ২০০৮ সালের সেপ্টেম্বর মাসে বিটিআরসি এ দুটি অপারেটরকে সারাদেশে দ্রুতগতির ব্রডব্যান্ড ইন্টারনেট সার্ভিস বিডব্লিউএ (ব্রডব্যান্ড ওয়্যারলেস অ্যাকসেস) সেবার লাইসেন্স প্রদান করে। আগামী মাসে তাদের ৫ বছর পূর্ণ হচ্ছে। গাইডলাইন অনুযায়ী কথা ছিল দুটি অপারেটর এ সময়ের মধ্যে দেশের ৬৪টি জেলা এমনকি উপজেলা ও প্রত্যন্ত গ্রামে তাদের ইন্টারনেট সেবা পৌঁছে দেবে। শর্ত অনুযায়ী প্রত্যেক অপারেটরকে ৫ বছরে কমপক্ষে ৫ মিলিয়ন করে গ্রাহককে সংযোগ দেয়ার কথা ছিল। কিন্তু দেখা গেছে দুটি অপারেটর মিলে ৫ বছরে গ্রাহক তৈরি করেছে মাত্র ৫ লাখ। জানা গেছে ৬৪ জেলা দূরের কথা, বর্তমানে রাজধানীর অধিকাংশ থানাতেও বাংলালায়ন ও কিউবির সংযোগ দেয়া সম্ভব হচ্ছে না। যারা সংযোগ নিয়েছেন তাদের অধিকাংশ গ্রাহক দিনে-রাতে গড়ে ৬-৭ ঘণ্টার বেশি ইন্টারনেট ব্যবহার করতে পারছেন না। বেশিরভাগ সময় সংযোগ বিচ্ছিন্ন থাকছে। একই সঙ্গে গ্রাহক সেবার মান উন্নয়ন, উন্নত সার্ভিস ও কম দামে ইন্টারনেট পৌঁছে দেয়ার যে অঙ্গীকার করেছিল সেটাও পূরণ করতে পারেনি অপারেটর দুটি। এই অবস্থায় সরকার বিডব্লিউএ গাইডলাইন পরিবর্তনের সিদ্ধান্ত নিয়েছে। গত সপ্তাহে জনসাধারণের মতামতের জন্য গাইডলাইনটি ডাক ও টেলিযোগাযোগ মন্ত্রণালয় তাদের ওয়েবসাইটে প্রকাশ করেছে। আজ মতামত প্রদানের শেষ দিন।
Related Posts Plugin for WordPress, Blogger...
আরো সংবাদ পড়ুন